উজ্জ্বল রায়■ (১২,নভেম্বর) ২৭৪:কার্তিক মাসের কৃষ্ণা একাদশী। ২৬শে (নভেম্বর), ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। শ্রীযুক্ত মণিলাল মল্লিকের বাটীতে সিঁদুরিয়াপটী ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশন হয়। বাড়িটি চিৎপুর রোডের উপর; পূর্ব ধারে হ্যারিসন রোডের চৌমাথা-যেখানে বেদানা, পোস্তা, আপেল এবং অন্যান্য মেওয়ার দোকান-সেখান হইতে কয়েকখানি দোকানবাড়ির উত্তরে। সমাজের অধিবেশন রাজপথের পার্শ্ববর্তী দুতলার হলঘরে হয়। আজ সমাজের সাংবৎসরিক, তাই মণিলাল মহোৎসব করিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সিঁদুরিয়াপটী ব্রাহ্মসমাজে আগমন ও শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রভৃতির সহিত কথোপকথন উপাসনাগৃহ আজ আনন্দপূর্ণ, বাহিরে ও ভিতরে হরিৎ বৃক্ষপল্লবে নানা পুষ্প ও পুষ্পমালায় সুশোভিত। গৃহমধ্যে ভক্তগণ আসন গ্রহণ করিয়া প্রতীক্ষা করিতেছেন, কখন উপাসনা হইবে। গৃহমধ্যে সকলের স্থান হয় নাই, অনেকেই পশ্চিমদিকের ছাদে বিচরণ করিতেছেন, বা যথাস্থানে স্থাপিত সুন্দর বিচিত্র কাষ্ঠাসনে উপবিষ্ট হইয়াছেন। মাঝে মাঝে গৃহস্বামী ও তাঁহার আতĄীয়গণ আসিয়া মিষ্ট সম্ভাষণে অভ্যাগত ভক্তবৃন্দকে আপ্যায়িত করিতেছেন। সন্ধ্যার পূর্ব হইতেই ব্রাহ্মভক্তগণ আসিতে আরম্ভ করিয়াছেন। তাঁহারা আজ একটি বিশেষ উৎসাহে উৎসাহান্বিত-শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শুভাগমন হইবে। ব্রাহ্মসমাজের নেতৃগণ কেশব, বিজয়, শিবনাথ প্রভৃতি ভক্তগণকে পরমহংসদেব বড় ভালবাসেন, তাই তিনি ব্রাহ্মভক্তদের এত প্রিয়। তিনি হরিপ্রেমে মাতোয়ারা। তাঁহার প্রেম, তাঁহার জ্বলন্ত বিশ্বাস, তাঁহার বালকের ন্যায় ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথন, ভগবানের জন্য ব্যাকুল হইয়া ক্রন্দন, তাঁহার মাতৃজ্ঞানে স্ত্রীজাতির পূজা, তাঁহার বিষয়কথা-বর্জন ও তলধারাতুল্য নিরবচ্ছিনś ঈশ্বরকথা প্রসঙ্গ, তাঁহার সর্বধর্ম-সমন্বয় ও অপর ধর্মে বিদ্বেষ-ভাবলেশশূন্যতা, তাঁহার ঈশ্বরভক্তের জন্য রোদন — এই সকল ব্যাপারে ব্রাহ্মভক্তদের চিত্তাকর্ষণ করিয়াছে। তাই আজ অনেকে বহুদূর হইতে তাঁহার দর্শনলাভার্থে আসিয়াছেন। শিবনাথ ও সত্যকথা-ঠাকুর ‘সমাধিমন্দিে উপাসনার পূর্বে শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও অন্যান্য ব্রাহ্মভক্তদের সহিত সহাস্যবদনে আলাপ করিতেছেন। সমাজগৃহে আলো জ্বালা হইল, অনতিবিলম্বে উপাসনা আরম্ভ হইবে। পরমহংসদেব বলিতেছেন, “হ্যাগা, শিবনাথ আসবে না?” একজন ব্রাহ্মভক্ত বলিতেছেন, “না, আজ তাঁর অনেক কাজ আছে, আসতে পারবেন না।” পরমহংসদেব বলিলেন, “শিবনাথকে দেখলে আমার আনন্দ হয়, যেন ভক্তিরসে ডুবে আছে; আর যাকে অনেকে গণে-মানে, তাতে নিশ্চয়ই ঈশ্বরের কিছু শক্তি আছে। তবে শিবনাথের একটা ভারী দোষ আছে — কথার ঠিক নাই। আমাকে বলেছিল যে, একবার ওখানে (দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে) যাবে, কিন্তু যায় নাই, আর কোন খবরও পাঠায় নাই, ওটা ভাল নয়। এইরকম আছে যে, সত্য কথাই কলির তপস্যা। সত্যকে আঁট করে ধরে থাকলে ভগবানলাভ হয়। সত্যে আঁট না থাকলে ক্রমে ক্রমে সব নষ্ট হয়। আমি এই ভেবে যদিও কখন বলে ফেলি যে বাহ্যে যাব, যদি বাহ্যে নাও পায় তবুও একবার গাড়ুটা সঙ্গে করে ঝাউতলার দিকে যাই। ভয় এই — পাছে সত্যের আঁট যায়। আমার এই অবস্থার পর মাকে ফুল হাতে করে বলেছিলাম, ‘মা! এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার শুচি, এই নাও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার ভাল, এই নাও তোমার মন্দ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার পুণ্য, এই নাও তোমার পাপ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।’ যখন এই সব বলেছিলুম, তখন এ-কথা বলিতে পারি নাই, ‘মা! এই নাও তোমার সত্য, এই নাও তোমার অসত্য।’ সব মাকে দিতে পারলুম, ‘সত্য’ মাকে দিতে পারলুম না।”ব্রাহ্মসমাজের পদ্ধতি অনুসারে উপাসনা আরম্ভ হইল। বেদীর উপর আচার্য, সম্মুখে সেজ। উদ্বোধনের পর আচার্য পরব্রহ্মের উদ্দেশে বেদোক্ত মহামন্ত্র উচ্চারণ করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মভক্তগণ সমস্বরে সেই পুরাতন আর্য ঋষির শ্রীমুখ-নিঃসৃত, তাঁহাদের সেই পবিত্র রসনার দ্বারা উচ্চারিত নামগান করিতে লাগিলেন। বলিতে লাগিলেন, “সত্যং জ্ঞানংমনন্তং ব্রহ্ম, আনন্দস্বরপমমৃতং যদ্বিভাতি, শান্তং শিবমদ্বৈতম্, শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্।” প্রণবসংযুক্ত এই ধ্বনি ভক্তদের হৃদয়াকাশে প্রতিধ্বনিত হইল। অনেকের অন্তরে বাসনা নির্বাপিতপ্রায় হইল। চিত্ত অনেকটা স্থির ও ধ্যানপ্রবণ হইতে লাগিল। সকলেরই চক্ষু মুদ্রিত-ক্ষণকালের জন্য বেদোক্ত সগুণ ব্রহ্মের চিন্তা করিতে লাগিলেন। পরমহংসদেব ভাবে নিমগ্ন। স্পন্দহীন, স্থিরদৃষ্টি, অবাক্ চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় বসিয়া আছেন। আত্মাপক্ষী কোথায় আনন্দে বিচরণ করিতেছেন, আর দেহটি মাত্র শূন্যমন্দিরে পড়িয়া রহিয়াছে। সমাধির অব্যবহিত পরেই চক্ষু মেলিয়া চারিদিকে চাহিতেছেন। দেখিলেন, সভাস্থ সকলেই নিমীলিত নেত্র। তখন ‘ব্রহ্ম’ ‘ব্রহ্ম’ বলিয়া হঠাৎ দ-ায়মান হইলেন। উপাসনান্তে ব্রাহ্মভক্তেরা খোল-করতাল লইয়া সংকীর্তন করিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমানন্দে মত্ত হইয়া তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দিলেন আর নৃত্য করিতে লাগিলেন। সকলে মুগ্ধ হইয়া সেই নৃত্য দেখিতেছেন। বিজয় ও অন্যান্য ভক্তেরাও তাঁহাকে বেড়িয়া বেড়িয়া নাচিতেছেন। অনেকে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখিয়া ও কীর্তনানন্দ সম্ভোগ করিয়া এককালে সংসার ভুলিয়া গেলেন — ক্ষণকালের জন্য হরি-রস-মদিরা পান করিয়া বিষয়ানন্দ ভুলিয়া গেলেন। বিষয়সুখের রস তিক্তবোধ হইতে লাগিল। কীর্তনান্তে সকলে আসন গ্রহণ করিলেন। ঠাকুর কি বলেন, শুনিবার জন্য সকলে তাঁহাকে ঘেরিয়া বসিলেন।
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Leave a Reply