লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যাকান্ডের ঘটনায় মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে আরও ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ছবিটি সোমবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টার থেকে তোলা -যাযাদি
লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যাকান্ডের ঘটনার পর দেশজুড়ে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের ধারাবাহিকতায় আরও ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
রোববার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ছয়জনকে ও অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।
ডিএমপির ডিবির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আবদুল বাতেন জানান, ডিবির হাতের গ্রেপ্তার হয়েছে- বাদশা মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া, আকবর আলী, সুজন, নাজমুল হাসান ও লিয়াকত শেখ ওরফে লিপু।
তাদের কাছ থেকে চারটি পাসপোর্ট, দুটি মোবাইল ফোন ও টাকার হিসাব সংবলিত দুটি নোটবুক উদ্ধার করা হয়।
দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বাতেন বলেন, লিবিয়ায় হত্যাকান্ডের ঘটনায় পল্টন থানা ও তেজগাঁও থানায় দায়ের করা মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় রোববার রাতে আটক এই ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
তাদের পাচারকর্ম তুলে ধরে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, লিবিয়ার বিভিন্ন এস্টেটে কাজ ও লিবিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচারের প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি দালালরা অন অ্যারাইভাল ভিসা ও ভিজিট ভিসার মাধ্যমে প্রথমে লিবিয়ায় পাচার করে। সেখানে বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রেখে তাদের উপর অমানুষিক শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।
‘তারা নির্যাতিত ভিকটিমদের কান্নাকাটি, আকুতি-মিনতি করা অডিও অথবা সরাসরি মোবাইলে কথাবার্তা বাংলাদেশে অবস্থানরত পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে পাঠায় ও টাকা দাবি করে। ভিকটিমদের বাঁচাতে তাদের আত্মীয়-স্বজন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিটাবাড়ি বিক্রি করেও টাকা পাঠায়।’
তিনি বলেন, লিবিয়ায় নিহত মাদারীপুরের সাতজনকে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় আমির হোসেনের কাছে পাচার করেছিল তার ভাই আকবর হোসেন। যাকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া আরেকজন বাদশা মিয়া ১৩ বছর ধরে লিবিয়ায় থাকেন। লিবিয়ার বেনগাজি ও জোয়ারা শহরে তার নিজস্ব ক্যাম্প আছে।
‘বাদশা নিয়মিত সারাদেশ থেকে লিবিয়াতে মানবপাচার করে, পাচার করা বাংলাদেশিদের তার ক্যাম্পে আটক রেখে সমুদ্রপথে ইটালিতে পাঠায়। মাদারীপুরের নিহতদের মধ্যে চারজনকে তার ক্যাম্পে আটক রেখে ত্রিপোলিতে পাচার করার এক পর্যায়ে এ হত্যাকান্ড ঘটে।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান বাতেন বলেন, রোববার গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে জাহাঙ্গীর ঢাকায় থেকে নিজস্ব কায়দায় বেনগাজিতে মানবপাচার ছাড়াও স্থানীয় অন্যান্য দালালদের কাছ থেকে পাওয়া পাসপোর্টগুলো স্ক্যান করে সফট কপি দুবাই ও লিবিয়াতে পাঠিয়ে টু্যরিস্ট ভিসা, অন অ্যারাইভাল মোয়াফাকা সংগ্রহ করে।
তিনি বলেন, ২৮ মের ঘটনায় আহত সজল, বিজয় ও ইছার উদ্দিনকে লিবিয়ায় পাঠান গ্রেপ্তারকৃত সুজন। সজল লিবিয়ার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকলেও অন্য দুজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন জানান, রোববার রাতে তাদের হাতে গ্রেপ্তার হন সোহাগ হোসেন (৫০), খালিদ চৌধুরী (৪২) ও সানজিদা (৩৮)। এদের দুজনের বাড়ি ঢাকায়, একজনের নরসিংদীতে।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত মানবপাচারের অভিযোগে সারাদেশে দায়ের হওয়া ১২টি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে সিআইডি। এর পল্টন থানায় দুটি ও বনানী থানায় একটি মামলার বাদী সিআইডি। গ্রেপ্তারকৃতদের এই দুই থানার কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যাকান্ডের পর মানবপাচার ও সন্ত্রাস দমন আইনে সারাদেশে ২২টি মামলায় রোববার পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে হিসেবে এই নয়জনকে ধরে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়ালো ২২ জনে।
গত ২৮ মে লিবিয়ার ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদাহে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে মানবপাচারকারী ও তাদের স্বজনরা। ওই ঘটনায় চার আফ্রিকান অভিবাসীও নিহত হন।
ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজনের বরাতে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উন্নত জীবিকার সন্ধানে ইউরোপ যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন ৩৮ বাংলাদেশি। বেনগাজি থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে মানবপাচারকারীরা তাদের ত্রিপোলি নিয়ে যাচ্ছিল।
বৃহস্পতিবার ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদাহে ওই দলটি লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়। তখন পাচারকারীরা আরও টাকা দাবি করে।
এ নিয়ে বচসার মধ্যে আফ্রিকার মূল পাচারকারীকে মেরে ফেলা হলে তার পরিবার এবং বাকি পাচারকারীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৩০ জনকে হত্যা করে। এতে আরও ১১ জন আহত হন।
Leave a Reply