মোঃ মজিবর রহমান শেখ ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি,,মাছে ভাতে বাঙালী । বহুল প্রচলিত এই প্রবাদটি বাঙালীর ঐতিহ্য ও জীবন পরিচালনায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের প্রধান খাবার ভাত ও মাছ। যা কোনো বাঙালীই অস্বীকার করতে পারবে না। তবে অতীত ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান রেখে কেউ ‘মাছে ভাতে বাঙালীর সত্যতা স্বীকার করলেও বাস্তবতার নিরিখে তা অস্বীকার করার সময় সম্মুখে দাঁড়িয়ে। কারণ দেশীয় প্রজাতি অর্থাৎ আমাদের অতি পরিচিত মাছ গুলো যেভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে, তাতে আগামী দিনের বাঙালী খাবার তালিকায় যুক্ত হবে নতুন কিছু। ভাতের সাথে মাছ শব্দটি উধাও হতে আর বেশি দিন বাকি নেই বলে মনে হচ্ছে।বর্ষার পানি জমা হতে না হতেই টাঙ্গন ব্যারাজের নদী-নালায় চলছে মা মাছ নিধনের ‘উৎসব’! একশ্রেণির জেলে টাঙ্গন নদী ও ব্যারাজের বিভিন্ন পয়েন্টে কারেন্ট, ফিকা জাল সহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মা মাছ ধরছেন। সেগুলো স্থানীয় হাটবাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি করলেও মৎস্য বিভাগকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ এই সময়টা মাছের প্রজননকালীন সময়। কঠোর নজরদারী না থাকায় স্থানীয় জেলেরা অবাধে মাছ ধরছে। আর এখন ধরা পড়ছে সব ধরনের পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ। মৎস্য আইনে ১ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত পোনামাছ ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। যদি কেউ এ আইন অমান্য করে মৎস্য নিধন করে তাহলে অর্থদণ্ড ও জেল জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ড হতে পারে। কিন্তু এর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ বাস্তবে দেখা যায়নি। ২৭ জুন শনিবার বিকালে সরেজমিনে , ঠাকুরগাঁও জেলার ৫টি উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে চলছে কারেন্ট জালের ব্যবসা । এই কারেন্ট জাল নিয়ে সাধারণ মানুষ মা মাছ নিধন করছে। ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার লাহিড়ী ছোট সিংগিয়া ব্রিজ, জাউনিয়া নহনানদীর ব্রিজ, ভোট পাড়া ব্রিজ, তীনাই ব্রিজ, হরিপুর, রানীশংকৈল, পীরগঞ্জ সহ ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলাধীন, উত্তর বঠিনা, রুহিয়া টাঙ্গন ব্যারাজ ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার পাটিয়াডাঙ্গী ব্রিজ, বরদেশ্বরী ব্রিজ, শুক নদসহ ব্যারাজের বিভিন্ন পয়েন্টে জেলেরা বাদাই, কারেন্ট, ফিকা, ছাপি জালসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে ডিমওয়ালা কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, পুঁটি, ডারকা, মলা, ঢেলা, শোল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বাইম, খলিশা, ফলি, চিংড়ি, টাকি, চিতল, বালিয়া, কাকিলা, চাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, নাপতানি, গুলশা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, মেনি, চেলি, কানপোনা, বাচা, বাটা, রিটা, পিয়ালি, জয়া, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, চান্দা, কাজলি, চ্যাং, ছোট চিংড়ি, বাতাসি, বড় বাইন, তারা বাইন, শালবাইন, কুচিয়া, খোকসা, খড়কুটি, টাটকিনি, ধুতরা, গচি, বইরালি, গোলসাসহ নাম না-জানা বহু প্রজাতির মাছ প্রকাশ্যে নিধন করছেন। যদিও দেশীয় প্রজাতির এই মাছগুলো বিলুপ্তির পথে।সরকারিভাবে মা মাছ নিধন নিষেধ থাকলেও প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতিদিন ডিমওয়ালা ওই মাছগুলো আশপাশের স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি করা হচ্ছে। মাছগুলো স্থানীয় লোকজন বেশি দাম হাঁকিয়ে কিনে নিচ্ছেন।জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন বাজারে ডিমওয়ালা মাছ ও পোনা মাছ প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি টেংরা ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা, পুঁটি ৪শ’ টাকা, মোয়া মাছ ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা, ডিমওয়ালা বোয়াল বিক্রি হচ্ছে ৬শ’ টাকা কেজি, শোল বা টাকি মাছের পোনাও ২ থেকে ৩শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশীয় মৎস্য সম্পদ রক্ষায় এটা বন্ধ হওয়া জরুরি।যদি প্রতি বছর আইন মেনে ব্যারাজে মাছ ধরা হয় তবে মিঠা পানির মাছের কোন অভাব পড়বে না। তা না হলে মৎস্য রাজ্যে, মৎস্য বংশ চিরতরে শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সচেতনতা মহল।ব্যারাজ এলাকার বাসিন্দা এনায়েত হোসেনসহ অনেকেই জানান, একটা সময় ছিল জেলে ও কৃষকেরা শখের বসে স্বল্প আকারে পোনা মাছ ধরত। আর এখন পোনা ও ডিমওয়ালা সব ধরণের মাছ নিধনের মহোৎসব চলছে। তাই এই সময় প্রশাসনের পক্ষ কঠোর নজরদারী ও পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধনে মৎস্য আইন প্রয়োগ করলে মাছের বংশ বৃদ্ধি করা সহজ হত।আর ব্যরাজের পানিতে স্রোত তৈরি হচ্ছে, সে স্রোতের পানিতেই রুই, ঘনিয়াসহ বিভিন্ন জাতের দেশি মাছ ডিম ছাড়বে। পানির স্রোত না থাকলে মাছ ডিম ছাড়তে পারে না। তাই টাঙ্গন ব্যারাজের স্রোতকে পুজি করেই চলছে মা মাছ নিধন।মা মাছ নিধনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুদৃষ্টি কামনা করছে এলাকার সাধারণ জনগণ।ঠাকুরগাঁও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো: আফতাব হোসেন বলেন, টাঙ্গন ব্যারাজে বিভিন্ন পয়েন্টে মা মাছ নিধনের বিষয়টি তিনি শুনেছেন। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে জনবল সংকটের কারণে পুরো এলাকায় একসাথে অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে এক এক করে সব জায়গায় অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে তিনি জানান।
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Leave a Reply